ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ার উপকূলে এক খন্ড সুন্দরবন

এম.আর. মাহমুদ ::

চকরিয়া সুন্দরবনের অস্তিত্ব এখন আর নেই। অন্তত ৩ যুগ আগে এ বনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। তারপরও সুন্দরবন এলাকার প্রবাহমান খাল, ছড়া ও জেগে উঠা চরে সৃজিত প্যারাবনের গাছগুলো দেখে মনে হয় দেশের দ্বিতীয় সুন্দরবনের অস্তিত্ব এখানেই বিদ্যমান ছিল। চকরিয়া সুন্দরবনের প্রায় ৯৫ ভাগ এলাকায় নেই প্যারাবন। আছে শুধু চিংড়িঘের ও লবণ মাঠ।

প্রবীণদের মতে চকরিয়ার উপকূল ধরে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হাতি ছাড়া সব প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। সৌখিন শিকারীরা দল বেঁধে এখানে হরিণসহ পাখি শিকার করত আর জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। তবে বর্তমান দৃশ্য দেখে মনে হয় এখানে কোন বনের অস্তিত্ব ছিল না। এক সময় চকরিয়া সুন্দরবন প্রায় ২৭ হাজার একর প্যারাবন জুড়ে ছিল সুন্দরী বাইন, কেওড়া, গেওয়াসহ হরেক প্রজাতির প্যারাবনের গাছ। কক্সবাজার বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে ছিল এই বিশাল বনভূমি। যা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জের। এ রেঞ্জের তেমন কোন কার্যক্রম না থাকলেও কাগজে কলমে অস্তিত্ব বিদ্যমান। সুন্দরবন রেঞ্জের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা। এ রেঞ্জের বিপরীতে ৩টি বনবিটও ছিল। বর্তমানে এসব বনবিটের বিপরীতে কোন জনবল নেই বলা চলে। ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে চকরিয়া সুন্দরবনের প্যারাবন নিধন করে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। সে সময় সরকার ৩৯ জন ভাগ্যবান ব্যক্তিকে ৩৯টি প্লটে বিভক্ত করে চিংড়ি চাষের জন্য লীজ দেয়। এ ৩৯ জন ভাগ্যবান ব্যক্তির মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত মেজর শরীফুল হক ডালিমের নামেও একটি ঘের ছিল। পরবর্তীতে এরশাদ জামানায় সামরিক ফরমানে ৩৯ জনের চিংড়িঘের বাতিল করে ১০ একর, ১১ একর ও ৩০ একর বিশিষ্ট ঘের করে লীজ দেয়। এর পর থেকেই পুরোপুরি সুন্দরবনের অস্তিত্ব কক্সবাজারের মানচিত্র থেকে মুছে যায়। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবে উপকূলীয় এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হয়। এ সময় পরিবেশবাদী কয়েকটি এনজিও সংস্থার অর্থায়নে চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় নতুন জেগে উঠা চর, খাল ও ছড়ার পাশেই পুনরায় সৃজন করা হয় প্যারাবন। কয়েকটি পয়েন্টে সৃজিত প্যারাবনের দৃশ্য দেখে মনে হয় এ যেন চকরিয়ার একখন্ড সুন্দরবন। চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ হোছাইন বিএসসি জানিয়েছেন, এক সময় চকরিয়ার সুন্দরবন ছিল অপরূপ একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। যার অবস্থান ছিল চকরিয়ার পশ্চিম অংশের বেশকিছু ৫ ইউনিয়ন জুড়ে। মৌজাগুলো হচ্ছে ফুলছড়ি, বহলতলী, উলুবনিয়া, ডুমখালী, কাটাখালী, ছগিরশাহ কাটা, রিংভং, পালাকাটা, সওদাগর ঘোনা, বদরখালী, রামপুর, পশ্চিম বড় ভেওলা, দরবেশকাটা, পেকুয়া উজানটিয়া ও করিয়ার দিয়া। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অধিক লাভের আশায় চিংড়ি সম্প্রসারণ হওয়ায় কার্যতঃ সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে এটি সুন্দরবন হিসেবে বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরবর্তীতে সুন্দরবন রেঞ্জের বনভূমি বনবিভাগ থেকে অবমুক্ত করে মৎস্য ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। যে কারণেই চকরিয়া সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিপণœ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া শাসকদলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অধিক লাভের আশায় সুন্দরবন এলাকায় চিংড়ি মহাল ঘোষণা করে লীজ প্রথা চালু করে। এতে সরকারী কোষাগারে রাজস্ব হলেও চকরিয়ার উপকূলের পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিপণœ হয়েছে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। অথচ অতীতেও এ ধরণের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলেও প্যারাবনের কারণে লোকালয়ে তেমন ক্ষয়-ক্ষতি হত না। সরকারী ও বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার মধ্যে উপকূলীয় বনবিভাগ ও জাপানের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওয়েস্কা ইন্টারন্যাশনাল ও নয়া কৃষি আন্দোলন (উবিনীগ) কর্তৃক সৃজিত প্যারাবনেরও বিশাল অংশ ধ্বংস করে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি চিংড়িঘেরে রূপান্তরিত করেছে। এসব ঘেরে বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি চাষ ও শুষ্ক মৌসুমে লবণ চাষ করে প্রতি বছর শত কোটি টাকা আয় করে যাচ্ছে। নির্বিচারে প্যারাবন উজাড়ের কারণে সুন্দরবন এলাকায় হাজার হাজার মহিষের পাল এখন আর চোখে পড়ে না। চরম খাদ্য সংকটে মহিষ পালন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী মহিষের দইও বিলুপ্তির পথে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রবীণদের মতে উপকূলীয় এলাকায় খাল, ছড়া, জেগে উঠা নতুন চরে পরিকল্পিতভাবে প্যারাবন সৃষ্টি করা হলে চকরিয়া সুন্দরবন এলাকা পুনরায় একখন্ড সুন্দরবনে পরিণত হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ভাষায় বলতে হয় “দাও ফিরিয়ে হে অরণ্য, লও এ নগর।”

লেখক :  মাহমুদুর রহমান মাহমুদ

পাঠকের মতামত: